![]() |
মানুষ বহুগামী হয় কেন |
মানুষের সম্পর্ক গুলো বড়ই জটিল এবং রহস্যময়। যখন দুটি মানুষ একে অপরের প্রতি ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়, তখন বিশ্বস্ততা এবং একনিষ্ঠতা সেই সম্পর্কের মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এই ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যায় এবং বহুগামিতার মতো জটিল বিষয় সামনে চলে আসে। কেন মানুষ বহুগামী হয়? এই প্রশ্নটি মনোবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী এবং সাধারণ মানুষের মনে বহু বছর ধরে ঘুরপাক খাচ্ছে। এটি কোনো সহজ প্রশ্ন নয় এবং এর উত্তরও এক কথায় দেওয়া সম্ভব না। এর পেছনে রয়েছে জৈবিক, মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক এবং ব্যক্তিগত নানা কারণের এক জটিল মিশ্রণ।
এই ব্লগ পোস্টে আমরা মানুষের বহুগামী হওয়ার পেছনের মূল কারণগুলো নিয়ে একটি বিশদ এবং গভীর আলোচনা করব, যা আপনাকে এই জটিল মানবিক আচরণটি বুঝতে সাহায্য করবে।
ভূমিকা: বহুগামিতা কী?
সহজ ভাষায়, বহুগামিতা (Polygamy বা Non-monogamy) হলো একজন ব্যক্তির তার নির্দিষ্ট সঙ্গীর বাইরেও অন্য এক বা একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে রোমান্টিক বা যৌন সম্পর্কে জড়ানো। এই সম্পর্কগুলো হতে পারে সম্মতিমূলক (যেমন: ওপেন রিলেশনশিপ) অথবা অজানাতে (যেমন: প্রতারণা)। সমাজে সাধারণত এটিকে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবেই দেখা হয় এবং এটি সম্পর্কের মধ্যে গভীর সংকট ও মানসিক কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মানুষ কেন বহুগামী হয় - এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের মানব প্রকৃতির গভীরে ডুব দিতে হবে।
জৈবিক এবং বিবর্তনীয় perspectiva
বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, মানুষের কিছু আচরণ তার পূর্বপুরুষদের থেকে প্রাপ্ত, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল বংশবৃদ্ধি এবং টিকে থাকা।
পুরুষের দৃষ্টিকোণ: বিবর্তনীয় তত্ত্ব অনুসারে, পুরুষের বহুগামী হওয়ার একটি জৈবিক তাড়না থাকতে পারে। এর কারণ হলো, একজন পুরুষ স্বল্প সময়ে একাধিক সঙ্গীর সঙ্গে মিলিত হয়ে তার জিন ছড়িয়ে দিতে এবং বংশবৃদ্ধির সম্ভাবনা বাড়াতে পারে। ইতিহাসে চোখ রাখলে দেখা যায়, অনেক সমাজেই শক্তিশালী এবং সম্পদশালী পুরুষদের একাধিক স্ত্রী বা সঙ্গী থাকত, যা তাদের বংশ বিস্তারে সহায়তা করত। এই আদিম প্রবৃত্তি আধুনিক যুগেও পুরুষের আচরণকে প্রভাবিত করতে পারে।
নারীর দৃষ্টিকোণ: অন্যদিকে, নারীদের ক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্ন। একজন নারীকে গর্ভধারণ এবং সন্তান পালনের জন্য দীর্ঘ সময় এবং শক্তি বিনিয়োগ করতে হয়। তাই সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে তারা অনেক বেশি সতর্ক থাকে। তবে, কিছু বিবর্তনীয় তত্ত্ববিদ মনে করেন, নারীরাও উন্নত জিন বা উন্নততর সুরক্ষা ও সম্পদের জন্য একাধিক সঙ্গীর প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে। যদি তার বর্তমান সঙ্গী তাকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা বা মানসিক সমর্থন দিতে ব্যর্থ হয়, তখন সে অন্য সঙ্গীর দিকে ঝুঁকতে পারে।
এই জৈবিক কারণগুলো একমাত্র নির্ধারক না হলেও মানুষের আচরণের একটি অংশকে ব্যাখ্যা করতে পারে।
মনস্তাত্ত্বিক কারণ: মনের গহীনে কী চলে?
মানুষের বহুগামী হওয়ার পেছনে মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতিটি মানুষ আলাদা এবং তাদের মানসিক গঠন, অভিজ্ঞতা ও চিন্তাভাবনাও ভিন্ন।
অপূর্ণতা এবং অসন্তুষ্টি: সম্পর্কের মধ্যে মানসিক বা শারীরিক অপূর্ণতা বহুগামিতার একটি অন্যতম প্রধান কারণ। যখন একজন ব্যক্তি তার সঙ্গীর কাছ থেকে পর্যাপ্ত ভালোবাসা, মনোযোগ, প্রশংসা বা যৌন সন্তুষ্টি পায় না, তখন সে সেই শূন্যতা পূরণের জন্য বাইরে অন্য কারো সন্ধান করতে পারে। সম্পর্কের অতৃপ্তি মানুষকে নতুন সম্পর্কের দিকে ঠেলে দেয়।
আত্মমর্যাদার অভাব (Low Self-Esteem): কিছু মানুষ নিজের আত্মমর্যাদা এবং আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য একাধিক সঙ্গীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়ায়। অন্যের কাছ থেকে আকর্ষণ ও মনোযোগ পাওয়া তাদের নিজেদের সম্পর্কে ভালো বোধ করতে সাহায্য করে। তারা মনে করে, একাধিক মানুষ তাদের চাইছে মানে তারা আকর্ষণীয় ও মূল্যবান।
নতুনত্বের প্রতি আকর্ষণ: দীর্ঘদিনের একঘেয়ে সম্পর্ক অনেক সময় মানুষের মধ্যে উত্তেজনা কমিয়ে দেয়। কিছু মানুষ নতুনত্ব এবং রোমাঞ্চ ভালোবাসে। নতুন সঙ্গীর সঙ্গে পরিচিত হওয়া, নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করার উত্তেজনা তাদের বহুগামী হতে প্ররোচিত করে। এই নতুনত্বের সন্ধান অনেক সময় আসক্তির মতো কাজ করে।
প্রতিশোধ স্পৃহা: অনেক ক্ষেত্রে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যও মানুষ বহুগামী হয়। যদি কোনো ব্যক্তি তার সঙ্গীর দ্বারা প্রতারিত হয় বা অবহেলিত বোধ করে, তবে সে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বা সঙ্গীকে কষ্ট দেওয়ার জন্য অন্য সম্পর্কে জড়াতে পারে।
সংযুক্তি শৈলী (Attachment Style): শৈশবের অভিজ্ঞতা আমাদের প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের সম্পর্ককে প্রভাবিত করে। যাদের শৈশবে বাবা-মায়ের সঙ্গে সুরক্ষিত এবং সংযুক্তি (secure attachment) তৈরি হয় না, তাদের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় সম্পর্কে জড়ানোর ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, 'avoidant attachment' স্টাইলের ব্যক্তিরা গভীর আবেগীয় সম্পর্ক এড়িয়ে চলতে চায় এবং একাধিক সম্পর্কে জড়াতে পারে।
মানসিক সমস্যা: কিছু মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন - নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার, বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার বা বাইপোলার ডিজঅর্ডারও ব্যক্তির বহুগামী আচরণের কারণ হতে পারে।
বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক এবং এর পেছনের মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলো বোঝা সম্পর্কের জটিলতা নিরসনে সাহায্য করতে পারে।
সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রভাব
সমাজ এবং সংস্কৃতি আমাদের আচরণ এবং মূল্যবোধ গঠনে বড় ভূমিকা রাখে।
সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা: যদিও বেশিরভাগ সংস্কৃতিতে একগামী সম্পর্কই আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হয়, কিছু সংস্কৃতিতে বা উপ-সংস্কৃতিতে বহুগামিতার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। আবার, আধুনিক সমাজে প্রযুক্তির সহজলভ্যতা এবং সামাজিক মাধ্যমের প্রসারের ফলে নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচিত হওয়া অনেক সহজ হয়ে গেছে।
প্রযুক্তির প্রভাব: ডেটিং অ্যাপস এবং সোশ্যাল মিডিয়া মানুষের জন্য নতুন সঙ্গী খুঁজে পাওয়াকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। এর ফলে, যারা তাদের বর্তমান সম্পর্কে সামান্যতম অসন্তুষ্ট, তারাও খুব সহজে বিকল্প খুঁজে নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। অনলাইন ডেটিং এবং প্রতারণা এখন একটি সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
লিঙ্গ বৈষম্য: অনেক পিতৃতান্ত্রিক সমাজে পুরুষের একাধিক সম্পর্কে জড়ানোকে পৌরুষের লক্ষণ হিসেবে দেখা হয়, অথচ নারীর ক্ষেত্রে এটিকে কঠোরভাবে দমন করা হয়। এই দ্বৈত নীতিও পুরুষের বহুগামী আচরণকে উস্কে দিতে পারে।
ব্যক্তিগত কারণ এবং সুযোগ
কিছু কারণ সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত পরিস্থিতি এবং সুযোগের ওপর নির্ভর করে।
সুযোগের সদ্ব্যবহার: অনেক সময় মানুষ বহুগামী হওয়ার পরিকল্পনা করে না, কিন্তু সুযোগ চলে এলে তারা সেই প্রলোভনকে অগ্রাহ্য করতে পারে না। কর্মক্ষেত্রে বা বন্ধুদের আড্ডায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে যেখানে একজন ব্যক্তি অপ্রত্যাশিতভাবে অন্য কারো প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে।
যোগাযোগের অভাব: সম্পর্কের মধ্যে সুস্থ যোগাযোগের অভাব একটি বড় সমস্যা। যখন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে খোলামেলা আলোচনা বন্ধ হয়ে যায়, তখন ভুল বোঝাবুঝি বাড়ে এবং মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়। এই দূরত্বই তৃতীয় ব্যক্তির প্রবেশের সুযোগ করে দেয়। সম্পর্কের জটিলতা এবং যোগাযোগের অভাব একে অপরের সাথে জড়িত।
ব্যক্তিগত মূল্যবোধ: পরিশেষে, একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত নৈতিকতা এবং মূল্যবোধ তার আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। যে ব্যক্তি বিশ্বস্ততাকে সম্পর্কের সর্বোচ্চ মূল্য দেয়, সে শত প্রলোভনের মুখেও নিজেকে সংযত রাখতে পারে। অন্যদিকে, যার কাছে ব্যক্তিগত আনন্দ বা উত্তেজনা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সে সহজেই বহুগামী সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে পারে।
উপসংহার: তাহলে সমাধান কী?
মানুষ কেন বহুগামী হয়, এর কোনো একক বা সহজ উত্তর নেই। এটি মানব প্রকৃতির এক জটিল এবং বহুমাত্রিক দিক, যার পেছনে জৈবিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং সামাজিক নানা কারণ জড়িত।
তবে, যেকোনো সম্পর্কের ভিত্তি হলো বিশ্বাস, সম্মান এবং খোলামেলা যোগাযোগ। যদি সম্পর্কে কোনো সমস্যা বা অপূর্ণতা দেখা দেয়, তবে সঙ্গীর সঙ্গে সেই বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করা অত্যন্ত জরুরি। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ বা কাউন্সেলরের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। একে অপরকে বোঝা, একে অপরের প্রয়োজনকে সম্মান করা এবং একসঙ্গে সমস্যার সমাধান করার প্রচেষ্টাই একটি সুস্থ ও দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কের চাবিকাঠি।
বহুগামিতা একটি সম্পর্কের জন্য চরম বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা হতে পারে, তবে এর পেছনের কারণগুলো বুঝতে পারলে হয়তো নিজেদের সম্পর্ককে আরও ভালোভাবে যত্ন নেওয়া এবং সুরক্ষিত রাখা সম্ভব।
Post a Comment