ক্যান্সার শব্দটি শুনলেই আমাদের মনে যে ভয়াবহ চিত্র ভেসে ওঠে, তার পেছনে প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থার বাইরেও ভিন্ন কিছু ধারণা প্রচলিত আছে। একটি তত্ত্ব অনুসারে, ক্যান্সার কেবল একটি রোগ নয়, বরং এটি একটি বিশাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যা ফার্মাসিউটিক্যাল এবং চিকিৎসা শিল্পের ট্রিলিয়ন ডলারের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এই ধারণা অনুযায়ী, রোগীদের পুরোপুরি সুস্থ করার চেয়ে তাদের একটি দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা প্রক্রিয়ার মধ্যে রাখতেই বেশি আগ্রহী এই শিল্প।
মূল কারণ কি আড়াল করা হচ্ছে?
এই তত্ত্বের প্রবক্তাদের মতে, ক্যান্সারের মূল কারণগুলো deliberatly এড়িয়ে যাওয়া হয়। তাদের মতে, ক্যান্সার মূলত শরীরে জমে থাকা বিষাক্ত পদার্থ (Toxin), রেডিয়েশন, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা এবং অস্বাস্থ্যকর খাবারের কারণে সৃষ্ট একটি শারীরিক প্রতিক্রিয়া। কোষের অস্বাভাবিক পরিবর্তনের মাধ্যমে শরীর এই বিষাক্ত অবস্থা থেকে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করে। কিন্তু প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থায় এই মূল কারণগুলো দূর না করে শুধু রোগের লক্ষণগুলো (Symptoms) দমন করার ওপর জোর দেওয়া হয়, যা রোগকে জিইয়ে রাখে।
ধনী এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিদের চিকিৎসার ভিন্ন ধারা
একটি সাধারণ প্রশ্ন হলো, কেন বিশ্বের বিলিয়নিয়ার, প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ বা তারকারা ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে প্রায়ই বেঁচে যান, যেখানে সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে ফলাফল হয় ঠিক তার উল্টো? এই তত্ত্ব অনুযায়ী, এর পেছনে কয়েকটি গোপন স্তর রয়েছে।
১. সাধারণের নাগালের বাইরের বিকল্প চিকিৎসা
বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা এমন কিছু বিকল্প চিকিৎসার সুযোগ পান যা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছায় না। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:
- জার্সন থেরাপি (Gerson Therapy): শরীরকে ডিটক্স বা বিষমুক্ত করে, লিভারকে সতেজ করে এবং ক্ষারীয় (Alkaline) খাবারের মাধ্যমে ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি রোধ করে।
- ওজোন থেরাপি (Ozone Therapy): শরীরে উচ্চমাত্রার অক্সিজেন প্রবেশ করিয়ে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করা হয়, কারণ ক্যান্সার কোষ অক্সিজেনের উপস্থিতি সহ্য করতে পারে না।
- হাই-ডোজ ভিটামিন সি (High-dose Vitamin C IV Therapy): শিরার মাধ্যমে উচ্চমাত্রার ভিটামিন-সি প্রয়োগ করে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে এমনভাবে শক্তিশালী করা হয়, যা ক্যান্সার কোষকে প্রতিহত করে।
- হাইপারবারিক অক্সিজেন চেম্বার (Hyperbaric Oxygen Chamber): উচ্চচাপযুক্ত অক্সিজেন-সমৃদ্ধ পরিবেশে রেখে ক্যান্সার কোষের প্রতিকূল পরিস্থিতি তৈরি করা হয়।
- অ্যালকালাইন ডায়েট (Alkaline Diet): কাঁচা এবং ক্ষারীয় খাবার গ্রহণের মাধ্যমে শরীরের pH স্তর এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে ক্যান্সার কোষের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে।
২. তাদের কেমোথেরাপিও ভিন্ন
বিকল্প চিকিৎসার পাশাপাশি, প্রভাবশালী ব্যক্তিরা যে কেমোথেরাপি পান, সেটিও সাধারণের চেয়ে উন্নত ও ভিন্ন।
- সাধারণ মানুষের জন্য: টক্সিক কেমোথেরাপি, যা ক্যান্সার কোষের সাথে শরীরের সুস্থ কোষও ধ্বংস করে দেয়। এর ফলে চুল পড়া, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হওয়াসহ মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
- প্রভাবশালী ব্যক্তিদের জন্য: পার্সোনালাইজড ও টার্গেটেড থেরাপি, যা শুধু নির্দিষ্ট ক্যান্সার কোষকে আক্রমণ করে। এর সাথে স্টেম সেল সাপোর্ট, ইমিউন বুস্টার এবং সাপ্লিমেন্ট ব্যবহার করে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সর্বনিম্ন রাখা হয়।
৩. ক্যান্সারকে জেনেটিক নয়, মেটাবলিক রোগ হিসেবে দেখা
এই ধারণা অনুযায়ী, ক্যান্সার কোনো জেনেটিক বা দুর্ভাগ্যজনিত রোগ নয়, বরং এটি একটি মেটাবলিক রোগ। এর অর্থ হলো, শরীরের বিপাকীয় প্রক্রিয়ার ত্রুটির ফলেই এর জন্ম।
- তাদের বিশ্বাস: ক্যান্সার কোষ টিকে থাকার জন্য প্রধানত গ্লুকোজ বা চিনির ওপর নির্ভর করে। তাই চিনি ও প্রক্রিয়াজাত খাবার পুরোপুরি বন্ধ করে, শরীরকে ডিটক্স করে এবং ক্ষারীয় খাবার গ্রহণ করলে ক্যান্সার কোষগুলো পুষ্টির অভাবে প্রাকৃতিকভাবেই মারা যায়।
- সাধারণ মানুষকে যা বলা হয়: এটি আপনার ভাগ্য, বংশগত রোগ এবং কেমোথেরাপি ছাড়া কোনো উপায় নেই। এই ভয় ও হতাশা রোগীর মানসিক শক্তি কেড়ে নেয় এবং রোগকে আরও জটিল করে তোলে।
তাহলে মুক্তির পথ কী?
এই বিকল্প ধারণা অনুযায়ী, ক্যান্সার মানেই মৃত্যুদণ্ড নয়। প্রচলিত চিকিৎসার পাশাপাশি বা এর বিকল্প হিসেবে কিছু প্রাকৃতিক পদ্ধতির কথা বলা হয়, যা ক্যান্সার প্রতিরোধ ও নিরাময়ে সহায়ক হতে পারে।
- ক্ষারীয় বা অ্যালকালাইন ডায়েট: এই তত্ত্ব মতে, ক্যান্সার কোষ অ্যাসিডিক পরিবেশে দ্রুত বাড়ে। ক্ষারীয় খাবার (যেমন সবুজ শাকসবজি, ফল) শরীরের pH ভারসাম্য ফিরিয়ে এনে ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে। ড. সেবি (Dr. Sebi) নামে একজন হোলিস্টিক চিকিৎসক শুধুমাত্র অ্যালকালাইন খাবারের মাধ্যমে বহু রোগীকে সুস্থ করার দাবি করেছিলেন, যাকে পরবর্তীতে চিকিৎসা জালিয়াতির অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় এবং তিনি কারাগারেই মারা যান।
- ভিটামিন বি-১৭ (Laetrile): এই তত্ত্বের অন্যতম বিতর্কিত একটি দিক হলো ভিটামিন বি-১৭ বা লেট্রিল (Laetrile) এর ব্যবহার। এটি মূলত অ্যাপ্রিকট ফলের বীচিতে পাওয়া যায়। দাবি করা হয় যে, এই উপাদানটি শরীরে প্রবেশ করে শুধুমাত্র ক্যান্সার কোষকে চিহ্নিত করে সায়ানাইড নিঃসরণের মাধ্যমে সেগুলোকে ধ্বংস করে, কিন্তু সুস্থ কোষের কোনো ক্ষতি করে না। ড. আর্নস্ট ক্রেবস (Dr. Ernst Krebs) সত্তর দশকে এটিকে ক্যান্সারের অন্যতম প্রতিরোধক হিসেবে দাবি করলেও FDA এটিকে বিষাক্ত এবং অকার্যকর বলে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
শেষ কথা
এই তত্ত্বের মূল বক্তব্য হলো, ক্যান্সারকে ঘিরে যে ভয় এবং তথ্যের সীমাবদ্ধতা তৈরি করা হয়েছে, তার পেছনে একটি বড় ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য রয়েছে। রোগীকে সারিয়ে তোলার চেয়ে তাকে আজীবন ভোক্তা বানিয়ে রাখাই এই চক্রের লক্ষ্য।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই নিবন্ধটি একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি বা প্রচলিত বিকল্প ধারণাগুলোকে তুলে ধরার উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছে এবং এটি কোনোভাবেই চিকিৎসা পরামর্শ হিসেবে গণ্য নয়। ক্যান্সারের মতো জটিল রোগের ক্ষেত্রে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অবশ্যই একজন রেজিস্টার্ড ও অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। এখানে উল্লিখিত কোনো থেরাপি বা পদ্ধতি চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া গ্রহণ করা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে।
Post a Comment